২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতির চাপে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে ভোক্তা। যার একটা প্রভাব পড়েছিল হাসিনা সরকারের পতনেও। দুই বছর ধরেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বিভিন্ন সময় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলনীতি আরো উসকে দেয় মূল্যস্ফীতিকে।
যার ফলে হাসিনা সরকারের নেওয়া সব পদক্ষেপই ভেঙে পড়ে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য লুকিয়ে রাখতে ঠিকই সক্ষম হয় হাসিনা সরকার। যতই বাজার অস্থিতিশীল হোক, পণ্যের দাম বাড়ুক, মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের নিচেই দেখাতে বাধ্য হয় সরকার নিয়ন্ত্রিত বিবিএস। তবে আওয়ামী সরকারেরই আরেক সংস্থা জানায়, বাস্তব মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশের বেশি ছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ করে চাল, আলু, আটা, ডিম, মাংসের দাম বাড়তে থাকে। তার পর থেকে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম কমেনি। দেশি পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকায় উঠে যায়। ডিমের দাম বেড়ে ডজনপ্রতি ১৮০ টাকায় ওঠে।
২০-৩০ টাকার আলু ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়। সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে যায়। ভোজ্য তেলের সংকট তৈরি করে লিটারে আট টাকা দাম বাড়াতে বাধ্য করে কম্পানিগুলো। মাছ, মুরগিসহ শাক-সবজির দামও অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। গত এক বছরের ব্যবধানে চাল, সয়াবিন তেল, দেশি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, আলু, ডিম ও ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ে।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য মতে, গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় চালের দাম ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, সয়াবিন খোলা তেল ৩ থেকে ৫ শতাংশ, পেঁয়াজ ৮ শতাংশ, রসুন কেজিতে ৫ থেকে ১৭ শতাংশ, আলু ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, ডিম দাম ৫ থেকে ১১ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত দুই বছরের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের মে মাসে দেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হলেও বিবিএস জানায় ৯.৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর ওপরে কখনো উঠতে দেয়নি। গত বছরের অক্টোবরে দেখানো হয় ৯.৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। চলতি বছরের মে মাসে দেখানো হয় ৯.৮৯ শতাংশ। গত জুনে সারা দেশে বন্যা হওয়ায় দেশের সব ধরনের পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, কিন্তু বিবিএস উল্টো হিসাব দিয়ে জানিয়েছিল, জুনে মূল্যস্ফীতি মাত্র ৯.৭২ শতাংশ! অথচ সরকার পতনের পর আগস্টে যখন অন্তর্বর্তী সরকার প্রকৃত মূল্যস্ফীতির তথ্য দেয়, তখন দেখা যায় জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৬৬ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই মাসে দেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়। খাদ্যে মূল্যস্ফীতিও গত ১৬ বছরের মধ্যে রেকর্ড ছাড়ায়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্ক টপকে এখন ১১.৬৬ শতাংশ, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.১০ শতাংশ। এর আগে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছিল ১২.৩ শতাংশ, আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকেছিল ১৬.৭২ শতাংশে।
পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এত দিন পরিসংখ্যান ব্যুরোকে যেকোনো তথ্য দিতে গেলে শুধু পরিকল্পনামন্ত্রীই নন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেরও অনুমোদন নিতে হতো। এখন আমি বলে দিয়েছি, আমার কাছে আসতে হবে না। স্বাধীনভাবে মাঠ পর্যায় থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাই প্রকাশ করতে হবে।’
সম্প্রতি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাছে খোদ ব্যুরোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, রাজনৈতিক চাপে সঠিক তথ্য দিতে অসহায় ছিলেন তাঁরা। কেননা সে সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া অর্থনীতির মৌলিক অনেক সূচকই প্রকাশ পেত না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, রাজনৈতিক চাপে সরকারি কর্মকর্তারা সঠিক তথ্য দিতে অসহায় ছিলেন। ফলে তাঁরা বাধ্য হয়েই যেকোনো বিষয়ে সরকারি তথ্য প্রাক্কলন করতেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিতে উল্টোনীতি নিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেন। যার ফলে পরবর্তী সময়ে তাঁর কোনো ওষুধে কাজ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পদত্যাগী গভর্নর সিন্ডিকেটের হয়েই কাজ করতেন। ফলে দেশের খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংক থেকে বেশির ভাগ নগদ অর্থ ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়ার পরই সুদহার বাড়িয়েছিলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগের সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। নতুন সরকার বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নিচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়ন হলে আশা করা যায় মূল্যস্ফীতি কমবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথমত আগের সরকার মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। আগের সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কথা বললেও কোথাও সংকোচন দেখা যায়নি। এখন কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে গিয়েছিল। তার কারণে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছিল। এখন যদি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা যায়, সংকোচননীতি ধরে রাখা যায়, ডলার সংকট কাটানো যায়, তাহলে আশা করা যায় শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমবে।